রক্তে আমার অনাদি অস্থি –দিলওয়ার খান
কবি পরিচিতি :
- নাম প্রকৃত নাম : দিলওয়ার খান।
- সংক্ষিপ্ত নাম : দিলওয়ার।
- সাধারণে পরিচিতি : গণমানুষের কবি।
- জন্মপরিচয় জন্ম তারিখ : পহেলা জানুয়ারি, ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ
- জন্মস্থান : ভার্থখলা, সিলেট।
- বংশ পরিচয় পিতার নাম : মৌলভী মোহাম্মদ হাসান খান।
- মাতার নাম : রহিমুন্নেসা।
- পেশা/কর্মজীবন শিক্ষকতা, সাংবাদিকতা (‘দৈনিক সংবাদ’, সহকারী সম্পাদক ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’); লেখক, কবি, ছড়াকার।
- কবিতার মূলসূর দেশ, মাটি, মানুষের প্রতি আস্থা ও দায়বদ্ধতা। গণমানবের মুক্তি ও বিভেদমুক্ত কল্যাণী পৃথিবীর প্রত্যাশা।
- সাহিত্য সাধনা কাব্য : ‘জিজ্ঞাসা’ (১৯৫৩), ‘ঐকতান, ‘উদ্ভিন্ন উল্লাস’, ‘স্বনিষ্ঠ সনেট’, ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি’, ‘স্বপৃথিবী রইবো সজীব’, ‘দুই মেরু দুই ডানা’, ‘অনতীত পংক্তিমালা’।
- প্রবন্ধ : বাংলাদেশ জন্ম না নিলে।
- ছড়া : দিলওয়ারের শতছড়া, ছড়ায় অ আ ক খ।
- পুরস্কার / সম্মাননা বাংলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক।
- জীবনাবসান মৃত্যু তারিখ : ১০ অক্টোবর, ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ।
কবি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
- দিলওয়ার ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে পহেলা জানুয়ারি সিলেট শহরসংলগ্ন সুরমা নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী ভার্থখলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
- কবি জীবনের শুরু থেকেই তিনি জনমনের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে পারিবারিক ‘খান’ পদবি বর্জন করেন।
- তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জিজ্ঞাসা’ প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে।
- তিনি ছিলেন মূলত সার্বক্ষণিক কবি লেখক ও ছড়াকার।
- তাঁর কবিতার মূল সুর দেশ, মাটি ও মানুষের প্রতি আস্থা ও দায়বদ্ধতা।
- গণমানবের মুক্তির লক্ষ্য বিভেদমুক্ত কল্যাণী পৃথিবীর তিনি স্বাপ্নিক।
- পেশাজীবনে প্রথমে দুমাস শিক্ষকতা করলেও ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকায় এবং ১৯৭৩-৭৪ খ্রিস্টাব্দে ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’ এ সহকারী সম্পাদক হিসেবে তিনি কাজ করেন।
মূলবাণী/মর্মবাণী/উপজীব্য বিষয়: সাগরদুহিতা ও নদীমাতৃক বাংলাদেশের বন্দনা এবং কবির নিজস্ব প্রত্যয় ও প্রতিশ্রুতির ঘোষণা/জাতিসত্তার শোণিত অস্থি ধারণ করা।
অধ্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় :
- ‘বাঙালি জাতিসত্তা আমাদের অস্তিত্বের উৎস’ বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবে।
- আপন অস্তিত্বের সঙ্গে বাঙালি জাতিসত্তার শানিত চেতনা ধারণ করতে উদ্বুদ্ধ হবে।
- এদেশের প্রধান নদ-নদী পদ্মা, মেঘনা, সুরমা প্রভৃতির অবদান সম্পর্কে জানতে পারবে।
- এদেশের দরিদ্র মানুষের জীবনবোধ ও শিল্পচেতনা সম্পর্কে ধারণা লাভ করবে।
- “প্রবহমান নদীর বাঁকের মতোই মানুষের জীবনও নানা সমস্যা ও জটিলতায় পূর্ণ” বিষয়টি অনুধাবন করতে পারবে।
- বিদেশি শাসক শোষকদের আগ্রাসন ও হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে নিন্দা, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে অনুপ্রাণিত হবে।
কবিতার ছন্দ বিশ্লেষণ
পদ্মা তোমার / যৌবন চাই
যমুনা তোমার / প্রেম (৬ + ৬ + ৬ + ২)
সুরমা তোমার / কাজল বুকের
পলিতে গলিত হেম। (৬ + ৬ + ৬ + ২)
বিশ্লেষণ :
উপরের দুই পংক্তির (চার লাইন) ছন্দ বিশ্লেষণ করে দেখা গেল ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি’ কবিতাটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। দুই পংক্তির মাত্রাবিন্যাস ৬ + ৬ + ৬ + ২। অর্থাৎ পংক্তিতে ৬ মাত্রার তিনটি পূর্ণ পর্ব ও ২ মাত্রার একটি অপূর্ণ পর্ব রয়েছে। সম্পূর্ণ কবিতাটি পাঠ করলে দেখা যায়, পুরো কবিতার মাত্রাবিন্যাসে এ মিল রক্ষিত হয়েছে। প্রতি দুই পংক্তির শেষ শব্দে অন্ত্যমিল রয়েছে। কবিতার যতি মধ্যম বা বিলম্বিত লয়ের।
ছন্দ : কবিতাটি ছয় মাত্রার মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। প্রতি পংক্তি ৬ + ৬ মাত্রার পূর্ণ পর্বে এবং ২ মাত্রার অপূর্ণ পর্বে বিন্যস্ত।
সারমর্ম:
‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি’ কবিতায় দিলওয়ার সাগরদুহিতা ও নদীমাতৃক বাংলাদেশের বন্দনা করেছেন এবং গণমানবের শিল্পী হিসেবে নিজের প্রত্যয় ও প্রতিশ্রæতি ঘোষণা করেছেন। কবি বলেছেন, এই বাংলার জীবনরূপ যেসব নদী নিরন্তর বয়ে চলেছে, গণশিল্পীর তুলি হাতে সেই বিচিত্র জীবনেরই তিনি রূপকার। তবে বহমান জীবনে এখানে বাধাহীন নয়। প্রবহমান নদীর বাঁকে বাঁকে পাতা রয়েছে মৃত্যুর ফাঁদ। কিন্তু কবি একথা জানতে ভোলেন না যে, তিনি তার স্বপ্নকে বিশাল বঙ্গোপসাগরের শক্তির কাছে আমানত রেখেছেন। এই শক্তিই সাগরের ঘূর্ণায়মান ভয়াল জলরাশির মতো তার ক্রোধকে শক্তিমান করেছে। আর এই ক্রোধ কেবল কবির একার নয়, সমগ্র জনগোষ্ঠীর সম্পদে পরিণত হয়েছে। এ কারণে বিদেশি নরদানবের আগ্রাসন এ জনগোষ্ঠীকে দমাতে পারে না। বিদেশীরা হয়ত জানে না যে, আবহমান ছুটে চলা নদীর মতোই কবি নিজের অস্তিত্বে ধারণ করে আছেন ওই জাতিসত্তার শোণিত ও অস্থি।
পাঠ বিশ্লেষণ
“পদ্মা তোমার যৌবন চাই/ যমুনা তোমার প্রেম
সুরমা তোমার কাজল বুকের/ পলিতে গলিত হেম।”
গণমানবের শিল্পী হিসেবে কবি তাঁর প্রত্যয় ও প্রতিশ্রুতি পূরণের লক্ষ্যে শক্তি প্রার্থনা করেছেন বাংলার প্রবহমান নদীর কাছে। তিনি পদ্মার প্রবহমান তীব্র স্রোতের কাছে যৌবনীশক্তি, যমুনার কাছে প্রেম আর সুরমার কাজল বুকের কাছে গলিত সোনা মেশানো পলিমাটি প্রার্থনা করেছেন। যাতে যৌবনশক্তির মাধ্যমে দেশ ও মানুষের কল্যাণ নিশ্চিত হয়, পারস্পরিক প্রেম ও সৌহার্দের বন্ধন সুদৃঢ় হয় এবং কৃষক বিপুল শস্য উৎপাদন করে দেশকে ধন-ধান্যে ভরিয়ে তুলতে পারে।
পদ্মা মেঘনা সুরমা যমুনা
গঙ্গা কর্ণফুলী,
তোমাদের বুকে আমি নিরবধি
গণমানবের তুলি !
বাংলার জীবন রূপ পদ্মা মেঘনা সুরমা গঙ্গা কর্ণফুলী নিরন্তর বয়ে চলেছে। বাংলাকে দিয়েছে পরিপূর্ণ আকর্ষণীয় অবয়ব ও জীবনীশক্তি। কবি গণশিল্পীর তুলি হাতে সেই বিচিত্র জীবনেরই রূপকার।
“কত বিচিত্র জীবনের রং/চারদিকে করে খেলা,
মুগ্ধ মরণ বাঁকে বাঁকে ঘুরে/ কাটায় মারণ খেলা!”
আমাদের জীবনের চারদিকে চলছে বিচিত্র খেলা। জীবন পরিচালনা করতে গেলে আমাদেরকে নানা চরিত্রের সাথে, বিভিন্ন সমস্যা জটিলতার সাথে, নানা দু:খ-যন্ত্রণা-শোকের মুখোমুখি হতে হয়। বিচিত্র তাদের প্রকৃতি, বিচিত্র তাদের গতিধারা। প্রবহমান নদীর বাঁকের মতো জীবনের বাঁকে বাঁকেও মৃত্যুর ফাঁদ পাতা। কিন্তু মানুষ সে সবে ভয় পায় না, সাহসের সাথে তা উৎরে যায়, মরণ খেলা অতিক্রম করে যায়।
“রেখেছি আমার প্রাণ স্বপ্নকে/ বঙ্গোপসাগরেই,
ভয়াল ঘূর্ণি সে আমার ক্রোধ/ উপমা যে তার নেই!”
কবি তাঁর প্রিয় স্বপ্নকে বিশাল বঙ্গোপসাগরের শক্তির কাছে আমানত রেখেছেন। কেননা স্রোতস্বিনী নদীগুলোর স্রোতশক্তি বঙ্গোপসাগরে গিয়েই মিলিত হয়েছে। এ শক্তিই সাগরের ঘূর্ণায়মান ভয়াল জলরাশির মতো কবির ক্রোধকে শক্তিমান করেছে।
“এই ক্রোধে জ্বলে আমার স্বজন / গণমানবের বুকে-
যখন বোঝাই প্রাণের জাহাজ/ নরদানবের মুখে!”
বিদেশি নরপিশাচরা মানবরূপী দানব। আগ্রাসনের লক্ষ্য নিয়ে তারা অত্যাচার-নিপীড়ন-হত্যা-ধবংসযজ্ঞ চালায়। তাদের এ হীন চক্রান্ত ও তান্ডবের বিরুদ্ধে ক্রোধে ফুঁসে ওঠেন কবি, তাঁর স্বজন ও ক্ষুদ্ধ জনতা। ‘প্রাণের জাহাজ’ রূপী জনতা ও জনসম্পদ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে উত্তাল হয়ে ওঠে। নরপশুরা বিপুল জনগোষ্ঠীকে দমাতে ব্যর্থ হয়।
“পদ্মা সুরমা মেঘনা যমুনা…? অশেষ নদী ও ঢেউ
রক্তে আমার অনাদি অস্থি, /বিদেশ জানে না কেউ!”
বাংলার বুকের ওপর পদ্মা সুরমা মেঘনা যমুনার মতো অশেষ স্রোতধারা ও অগণিত বিশাল ঢেউ বয়ে চলেছে। এসব নদীর পলিমাটিই নির্মাণ করেছে বাংলার শোণিত ও অস্থি। নদীস্রোত কোন বাধা মানে না, পরাজিত হতে জানে না। তাদেরই সত্তায় নির্মিথ হয়েছে বাঙালির জাতিসত্তা আবহমান নদীর মতোই কবি নিজের অস্তিত্বে ধারণ করে আছেন জাতিসত্তার শোণিত ও অস্থি, যা তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে জানে, মানুষরূপী দানবদের পরাজিত করতে জানেন।
কবিতাটির গুরুত্বপূর্ণ লাইন:
সুরমা তোমার কাজল বুকের
পলিতে গলিত হেম।
কত বিচিত্র জীবনের রং
চারদিকে করে খেলা
মুগ্ধ মরণ বাঁকে বাঁকে ঘুরে
কাটায় মারণ বেলা!
ভয়াল ঘূর্ণি সে আমার ক্রোধ
উপমা যে তার নেই!
এই ক্রোধে জ্বলে আমার স্বজন
‘গণমানবের বুকে
গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (জ্ঞানমূলক):
- ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি’ কবিতাটি নেয়া হয়েছে- ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি’ কাব্যগ্রন্থ থেকে। কবিতাটি এই কাব্যগ্রন্থের নামকবিতা।
- ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় – ১৯৮১ সালে সিলেট থেকে।
- এই কবিতাটি উৎসর্গিত – কবীর চৌধুরীর উদ্দেশ্যে।
- কবিতায় কবি নিজের প্রত্যয় ও প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছেন – গণ মানবের শিল্পী হিসেবে।
- বঙ্গোপসাগরের শক্তি সাগরের ঘূর্ণায়মান ভয়াল জলরাশির মতো শক্তিমান করেছে-কবির ক্রোধকে।
- বিদেশি নরদানবের আগ্রাসন এ জনগোষ্ঠীকে থামাতে পারে না, কারণ – কবির ক্রোধ সমগ্র জনগোষ্ঠীর সম্পদে পরিণত হয়েছে।
- কবি নিজের অস্তিতে ধারণ করে আছেন – জাতিসত্তার শোণিত অস্থি।
- কবির মতে- পদ্মার কাছে আছে – যৌবন।
- যমুনার কাছে আছে – প্রেম।
- সুরমার কাছে আছে – পলিতে গলিত হেম।
- ‘মুগ্ধ মরণ বাঁকে বাঁকে ঘুরে কাটায় মারণ বেলা’- এখানে ‘মারণ বেলা’ বলতে বোঝানো হয়েছে- বিনাশ কাল বা হনন কাল।
- কবি উপমা দিতে পারেননি – তার ক্রোধের।
- কবি তার ক্রোধের তুলনা করেছেন- ভয়াল ঘূর্ণির সাথে।
- ‘যখন বোঝাই প্রাণের জাহাজ নরদানবের মুখে’- এখানে ‘প্রাণের জাহাজ’ বলতে বোঝানো হয়েছে – জনতা ও জনসম্পদ।
- ‘পদ্মা সুরমা মেঘনা যমুনা’- এর পরের চরণ – অশেষ নদী ও ঢেউ।
- ‘পদ্মা যমুনা সুরমা মেঘনা’ এর পরের চরণ – গঙ্গা কর্ণফুলী।
অনুধাবনমূলক প্রশ্ন ও উত্তর :
১। কীভাবে কবি তাঁর ক্রোধকে শক্তিমান করেছেন? বুঝিয়ে লেখ।
উত্তর : সমুদ্রের বিশাল ঘূর্ণ্যমান জলরাশি দেখে কবি তাঁর ক্রোধকে শক্তিমান করেছেন। কবি বিদেশি নরদানবের আগ্রাসন দেখে ক্ষুদ্ধ। তিনি চান বাঙালি জাতি যেন তাদের নিজস্ব অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখে। কিন্তু মানুষরূপী নরপশুরা অত্যাচার, নির্যাতন-নিপীড়ন করে বাঙালিদের অধিকারবঞ্চিত করতে চায়। তা দেখে কবি ক্ষুদ্ধ। সমুদ্রের বিশাল জলরাশি যেমন সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়, কবিও চান বিপক্ষ শক্তিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে। তাই কবি সমুদ্রের ঘূর্ণ্যমান ভয়াল জলরাশির মতো তাঁর ক্রোধকে শক্তিমান করেছেন।
২। কবি বঙ্গোপসাগরের কাছে তাঁর প্রাণের স্বপ্নকে রেখেছেন কীভাবে?
উত্তর : বঙ্গোপসাগরের বিশালতার সঙ্গে ঐক্যসূত্র অনুভব করে কবি বঙ্গোপসাগরের কাছে তাঁর প্রাণের স্বপ্নকে রেখেছেন। সাগর যেমন বিশাল, কবির স্বপ্নও তেমনি বিশাল। সে স্বপ্ন হলো নিজের অস্তিত্ব ও বাঙালি জাতিসত্তাকে বিদেশি আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা করার স্বপ্ন। কবি চান দেশ তথা জাতি এ স্বপ্নকে ধারণ করুক। বিদেশিরা বুঝতে পারুক বঙ্গোপসাগর যেমন বিশাল, বাঙালি জাতির স্বপ্নও তেমন বিশাল।
৩। ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি’ কবিতায় সুরমা নদীর প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে কেন?
উত্তর : ভূমির উর্বরতায় সুরমা নদীর অসামান্য অবদানের কারণে ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি’ কবিতায় সুরমা নদীর প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে। নদীর পানিতে যে পলি বাহিত হয় তা অত্যন্ত মূল্যবান। কেননা এই পলি ভূমির উর্বরতা বাড়ায়। এই উর্বর মাটিতে সোনার ফসল ফলে। তাই কবি সুরমা নদীতে মিশ্রিত পলিমাটিকে গলিত সোনার সঙ্গে তুলনা করেছেন। সুরমা নদীর এ অবদানের কারণেই কবিতায় সুরমা নদীর প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে।
৪। ‘বহমান জীবন এখানে বাধাহীন নয়’ কথাটি দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর : বহমান জীবনে যে নানা বাধা বিঘœ থাকে, আলোচ্য কথাটি দ্বারা সে বিষয়টি বোঝানো হয়েছে। নদী তার চলার পথে নানা জায়গায় বাধা পায়, আবার এগিয়ে চলে। অনুরূপভাবে বাঙালি জাতির জীবনও তেমনি বহমান। শত বাধা পেলেও বাঙালির চেতনা এক বিন্দু পরিমাণও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় না। আলোচ্য কথাটি দ্বারা বাঙালির এমন সংগ্রামমুখর বহমান জীবনকেই বোঝানো হয়েছে।
৫। কবি নিজেকে গণমানবের শিল্পী হিসেবে কীভাবে উপস্থাপন করেছেন?
উত্তর : কবি তাঁর চেতনা ও সৃষ্টিতে নিজেকে গণমানবের শিল্পী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি’ কবিতায় কবি গণমানবের শিল্পী হিসেবে নিজের প্রতিশ্রুতি ও প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। কারণ তিনি তাঁর দেশ ও দেশের মানুষকে অকৃত্রিমভাবে ভালোবাসেন। এই বাংলার সাধারণ মানুষের যে নিরন্তর জীবনপ্রবাহ, তাকেই কবি তাঁর চেতনা ও সাহিত্যকর্মের মূল উপজীব্য করেছেন। এভাবেই সহৃদয় আন্তরিকতায় কবি নিজেকে গণমানবের শিল্পী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
৬। ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি’ কবিতায় কবি কীভাবে মানুষের প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছেন? ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি’ কবিতায় কবি মানুষের সম্ভাবনা ও ভালোবাসাকে প্রত্যক্ষ করেই তার প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছেন। কবি এদেশে বিচিত্র মানুষের সমাগমকে লক্ষ করেছেন এবং দেখেছেন তাদের নানামুখী কর্মতৎপরতা। মানুষের বিচিত্র জীবনের মধ্যে তিনি অমিত সম্ভাবনাকে প্রত্যক্ষ করেছেন এবং মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসাকে প্রত্যক্ষ করেছেন। এ কারণেই কবি মানুষের প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছেন।
৭। বাংলার মাটিতে কীভাবে গলিত সোনা মিশে আছে?
উত্তর : বাংলার মাটিতে পলিরূপে গলিত শোনা মিশে আছে। বাংলাদেশ নদীমাতৃক কৃষিপ্রধান দেশ। বর্ষাকালে কিংবা বন্যার সময় এদেশের ফসলি জমিতে যোগ হয় সোনারঙা পলিমাটি। কবি সে পলিমাটিকেই সোনা মেশানো বলেছেন, কারণ এ মাটিতেই ফলে সোনার ফসল। যে মাটি খাঁটি সোনার মতোই মূল্যবান। তাই বলা যায় পলিরূপে বাংলার মাটিতে গলিত সোনা মিশে আছে।
৮। জীবনরূপ নদী নিরন্তর বয়ে যাচ্ছে কেন?
উত্তর : বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে মিশে আরও শক্তিশালী হতে জীবনরূপ নদী নিরন্তর বয়ে যাচ্ছে। অনাবিল আনন্দের সঙ্গে বয়ে যাওয়াই নদীর ধর্ম। নদী এভাবে বয়ে যেতে যেতে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে মিশে গিয়ে এক ব্যাপক শক্তিতে পরিণত হয়। এখানে মূলত নদীর নিরন্তর পথচলা দ্বারা বাঙালি জাতির স্বাধীনচেতা সংগ্রামী মনোভাববেই বোঝানো হয়েছে। নদীর অসীম শক্তিকে কবি বাঙালির সংগ্রামী চেতনা ও শক্তির সঙ্গে তুলনা করেছেন। সমস্ত বিদেশি শক্তি বাঙালির সেই শক্তির কাছে তুচ্ছ।
৯। ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি’ কবিতা শিরোনামের ভাবার্থ কী?
উত্তর : জাতিসত্তার শোণিত ও অস্থি কবি নিজের অস্তিত্বে ধারণ করে আছেন, ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি’ কবিতার শিরোনামে সে কথাই ব্যক্ত হয়েছে। ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি’ কবিতায় কবিকে দেখা যায় দেশ ও মাটির কবি হিসেবে। কিন্তু তিনি মনে করেন, শুধু দেশপ্রেম নয়, তাঁর রক্তে প্রবহমান রয়েছে জাতিসত্তার শোণিত অস্থি, যাকে রুখতে পারবে না কোন বিদেশি আগ্রাসন। এটিই কবিতার শিরোনামের ভাবার্থ।
১০। “ভয়াল ঘূর্ণি সে আমার ক্রোধ” – কথাটি বুঝিয়ে দাও।
উত্তর : ‘ভয়াল ঘূর্ণি সে আমার ক্রোধ’ লাইনটি দ্বারা কবি প্রমত্তা পদ্মার ভয়াল রূপকে নির্দেশ করেছেন। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা নদীগুলো এ দেশের প্রাণ। এ দেশের নদ-নদীর অবদানেই আবর্তিত হয় এখানকার মানুষের জীবনধারা, স্বপ্ন, প্রত্যাশার চেতনা প্রভৃতি। বর্ষায় প্রমত্তা এ নদীগুলোর বাঁকে বাঁকে পাতা থাকে মরণফাঁদ। নদীর উন্মত্ততায় তখন ভয়াল ঘূর্ণিস্রোতর সৃষ্টি হয়। এ যেন নদীর ক্রোধের শক্তিময় প্রকাশ। এ শক্তি এ দেশের গণমানুষের সম্পদে পরিণত হয়। লাইনটির দ্বারা এ ভাবকেই তুলে ধরা হয়েছে।
উদ্দীপকের বিষয় :
- বিদেশি শাসকগোষ্ঠীর আগ্রাসন।
- সাগরের ঘূর্ণমান জলরাশির শক্তি।
- জাতীয় জীবনে ঐতিহ্য ও কবির কল্পনা।
- বাংলার নদ-নদীর বর্তমান অবস্থা এবং আমাদের করণীয়।
- বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
- বিদেশি শাসন শোষণ।
- নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর অবদান।
- একই নদীর ভিন্ন ভিন্ন রূপ।
- বাংলার ভূ-প্রকৃতি ও জীবনযাত্রা সম্পর্কে বিদেশি হানাদারের ধারণা।
- শোষণের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহŸান।
- দখলদারদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামী চেতনা।
- নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীর বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব।
- সচেতনতা ও একাতবদ্ধতার সুফল।
সারকথা :
- আলোচ্য কবিতায় কবি বাঙালি জীবনকে বাংলার নদীর সাথে তুলনা করে নদীমাতৃক বাংলাদেশের বন্দনা করেছেন। প্রদত্ত উদ্দীপকে কবিতার এই দিকটিই ফুটে উঠেছে।
- উদ্দীপকে নদীর প্রতি কবির ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। আলোচ্য কবিতায় উক্ত বিষয়টি ছাড়াও বাঙালি জাতিসত্তার কাছে নদীর গ্রহণযোগ্যতা, অবদান, অস্তিত্বের পরিচয়, দেশ বন্দনা ইত্যাদি বিষয় আলোচনা করা হয়েছে।
- ‘বহমান জীবন বাধাহীন নয়’ বলতে কবি মানবজীবনকে নদীর বহমানতার সাথে তুলনা করেছেন।
নং | বিষয় | লেখক |
১ | আমার পথ | কাজী নজরুল ইসলাম |
২ | বিড়াল | বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় |
৩ | চাষার দুক্ষু | বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত |
৪ | সাম্যবাদী | কাজী নজরুল ইসলাম |
৫ | ঐকতান | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
৬ | বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ | মাইকেল মধূসুদন দত্ত |
৭ | বায়ান্নর দিনগুলো | শেখ মুজিবুর রহমান |
৮ | অপরিচিতা | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
৯ | মাসি-পিসি | মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় |
১০ | জীবন ও বৃক্ষ | মোতাহের হোসেন চৌধুরী |
১১ | আমি কিংবদন্তির কথা বলছি | আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ |
১২ | নেকলেস | গী দ্য মোপাসাঁ/ পূর্ণেন্দু দস্তিদার |
১৩ | রেইনকোট | আখতারুজ্জামান ইলিয়াস |
১৪ | নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় | সৈয়দ শামসুল হক |
১৫ | তাহারেই পড়ে মনে | সুফিয়া কামাল |
১৬ | ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ | শামসুর রাহমান |