লোক লোকান্তর- মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ
কবি পরিচিতি :
- নাম প্রকৃত নাম : মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ।
- সাহিত্যিক নাম : আল মাহমুদ।
- জন্মপরিচয় জন্ম তারিখ : ১১জুলাই, ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ
- জন্মস্থান : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোড়াইল গ্রাম।
- পিতৃ ও মাতৃ পরিচয় পিতার নাম : আবদুর রব মীর।
- মাতার নাম : রওশন আরা মীর।
- শিক্ষাজীবন মাধ্যমিক : ব্রাহ্মণবাড়িয়া জর্জ সিক্সথ হাইস্কুল।
- পেশা/কর্মজীবন সাংবাদিকতা ও চাকরি। পরিচালক-বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ; সম্পাদক-দৈনিক গণকণ্ঠ ;
- সম্পাদক- দৈনিক কর্ণফুলী।
- সাহিত্যকর্ম কাব্যগ্রন্থ : লোক লোকান্তর, কালের কলস, সোনালী কাবিন, বখতিয়ারের ঘোড়া, মায়াবী পর্দা দুলে উঠো, মিথ্যেবাদী রাখাল, দ্বিতীয় ভাঙন, নদীর ভিতরে নদী ইত্যাদি।
- উপন্যাস : ডাহুকী, নিশিন্দা নারী, আগুনের মেয়ে, পুরুষ সুন্দর, উপমহাদেশ ইত্যাদি।
- প্রবন্ধ : কবির আত্মবিশ্বাস, দিনযাপন, নারী নিগ্রহ ইত্যাদি।
- গল্পগ্রন্থ : পানকৌড়ির রক্ত, গল্পবণিক, প্রেমের গল্প, ময়ূরীর মুখ ইত্যাদি।
- জীবনী : মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স:)।
- পুরস্কার / সম্মাননা বাংলা একাডেমী পুরস্কার, জয় বাংলা সাহিত্য পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ লেখক সংঘ পুরস্কার প্রভৃতি।
কবি সম্পর্কে গুরুত্তপূর্ণ তথ্য:
- তাঁর প্রকৃত নাম মির আবদুস শুকুর আল মাহমুদ।
- ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’ ও ‘দৈনিক কর্ণফুলী’ পত্রিকায় সম্পাদক ছিলেন তিনি। পরে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে যোগদান করেন এবং পরিচালকের পদ থেকে অবসরে যান।
- আধুনিক বাংলা কবিতায় আল মাহমুদ অনন্য এক জগৎ তৈরি করেন। সেই জগৎ যন্ত্রণাদগ্ধ শহরজীবন নিয়ে নয়, স্নিগ্ধ-শ্যামল, প্রশান্ত গ্রাম জীবন নিয়ে।
উৎস পরিচিতি:
এ কবিতাটি আল মাহমুদের ‘লোক লোকান্তর’ কাব্যের নাম কবিতা। এটি কবির আত্মপরিচয়মূলক কবিতা। কবির চেতনা যেন সত্যিকারের সপ্রাণ এক অস্তিত্ব পাখিতুল্য সেই কবিসত্তা সুন্দরের ও রহস্যময়তার স্বপ্নসৌধ বিরাজমান। প্রাণের মধ্যে প্রকৃতির মধ্যে সৃষ্টির মধ্যে তার বসবাস।
মূলবাণী/মর্মবাণী/উপজীব্য বিষয়: কবির আত্মপরিচয়মূলক বর্ণনা/সৃষ্টির আনন্দ।
শব্দার্থ ও টীকা:
- আমার চেতনা…
- চন্দনের ডালে – কবি তাঁর কাব্যবোধ ও কাব্যচেতনাকে সাদা এক সত্যিকার পাখির প্রতিমায় উপস্থাপন করেছেন।
- মাথার ওপরে নিচে…হয়ে
- আছে ঠোঁট তার – চন্দনের ডালে বসে থাকা কবির চেতনা-পাখির ওপরে-নিচে বনচারী বাতাসের সঙ্গে দোল খায় পানলতা।
- আর দুটি চোখের।
- কোটরে…ঝোপের ওপরে – কবির অস্তিত্ব জুড়ে চিরায়ত গ্রামবাংলা- দৃষ্টিতে কাটা সুপারির রং।
- তাকাতে পারি নি আমি ..
- কবিতার আসন্ন বিজয় – সৃষ্টির প্রেরণায় কবি চিরকালই উদ্বুদ্ধ হন, উজ্জ্বল হয় তাঁর চেতনার মণি।
ছন্দ বিশ্লেষণ:
আমার চেতনা যেন/ একটি শাদা / সত্যিকার পাখি,
বাসে আছে সবুজ অ / রণ্যে এক / চন্দনের ডালে;
মাথার উপরে নিচে/বনচারী/ বাতাসের তালে
দোলে বন্য পানলতা, / সুগন্ধ পরাগে / মাখামাখি
বিশ্লেষণ :
‘লোক লোকান্তর’ কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত চৌদ্দ পংক্তি ও ১৮ মাত্রার একটি সনেট। উপরের চার পংক্তির ছন্দ বিশ্লেষণে দেখা যায় কবিতাটি ৮ + ৪ + ৬ ও ৮ + ৬ + ৪ মাত্রায় অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত এবং প্রতি চরণে তিনটি করে পর্ব। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় চরণ ৮ + ৪ + ৬ মাত্রার তিন পর্বে বিভক্ত এবং চতুর্থ চরণে ৮ + ৬ + ৪ মাত্রার তিন পর্বে বিভক্ত। দ্বিতীয় চরণে ‘অরণ্য’ শব্দটির মধ্যখণ্ডন হয়েছে। সনেটটির মিলবিন্যাস : কখখক, গঘঘগ, ঙচচঙচঙ।
গুরুত্বপূর্ণ পংক্তি:
আমার চেতনা যেন একটি সাদা সত্যিকার পাখি,
হয়ে আছে ঠোঁট তার। আর দুটি চোখের কোটরে
কাটা সুপারির রং, পা সবুজ, নখ তীব্র লাল
চোখ যে রাখতে নারি এত বন্য ঝোপের ওপরে।
মনে হয় কেটে যাবে, ছিঁড়ে যাবে সমস্ত বাঁধুনি
সংসার সমাজ ধর্ম তুচ্ছ হয়ে যাবে লোকালয়।
আহত কবির গান। কবিতার আসন্ন বিজয়।
কবিতার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
- কবিতার মোট লাইন সংখ্যা : ১৪টি
- মোট বিরাম চিহ্ন : ১২টি (৩ প্রকার)
- পাদচ্ছেদ (কমা) : ৬টি
- সেমিকোলন : ১টি
- পুর্ণচ্ছেদ : ৫টি
এছাড়া উলেখ আছে-সাদা সত্যিকার পাখি, সবুজ অরণ্য, চন্দনের ডাল, বনচারী বাতাস, বন্য পানলতা, সুগন্ধ পরাগ, কাটা সুপারির রং, সবুজ পা, নখ তীব্রলাল, চেতনার মণি, আহত কবির গান।
কবিতার অন্তনির্হিত তাৎপর্য
চেতনার জগতে জয়ের উল্লাস ও বিচ্ছিন্নতাবোধ: “লোক থেকে লোকান্তরে……..কবিতার আসন্ন বিজয়।
আবহমান বাংলার রূপ: ‘চোখ যে রাখতে নারি এত বন্য ঝোপের উপরে।”
নেসর্গিক মনঃসমীক্ষা: “সুগন্ধ পরাগে মাখামাখি হয়ে আছে ঠোঁট তার।” এবং “আর দুটি চোখের কোটরে…..তে বন্য ঝোপের ওপরে।”
আত্মতত্ত¡ ব্যঞ্জনা: “আমার চেতনা যেন একটি সাদা……….এক চন্দনের ডালে,”
সৌন্দর্যের চিরায়িত মানস: “তাকাতে পারিনা আমি………তুচ্ছ হয়ে যাবে লোকালয়।’
সারমর্ম:
এটি কবির আত্মপরিচয় মূলক কবিতা। কবির চেতনা যেন সত্যিকারের সপ্রাণ এক অস্তিত্ব পাখিতুল্য সেই কবিসত্তা সুন্দরের ও রহস্যময়তার স্বপ্নসৌধ বিরাজমান। প্রাণের মধ্যে, প্রকৃতির মধ্যে সৃষ্টির মধ্যে তার বসবাস। কবি চিত্রকল্পের মালা গেঁথে তার কাব্য চেতনাকে মূর্ত করে তুলতে চান। এ কবিতায় এক সুগভীর বিচ্ছিন্নতাবোধে যন্ত্রণা কবিকে কাতর করে। তবু কবি সৃষ্টির আনন্দকে উপভোগ করতে আগ্রহী। তার সৃষ্টির বিজয় অবশ্যম্ভাবী এই প্রত্যয় তার বিচ্ছিন্নতাবোধের বেদনাকে প্রশমিত করে।
পাঠ বিশ্লেষণ:
“আমরা চেতনা যেন একটি সাদা সত্যিকার পাখি,
বসে আছে সবুজ অরণ্যে এক চন্দনের ডালে;”
কবি তাঁর কাব্যচেতনাকে সত্যিকার এক সাদা পাখির সাথে তুলনা করেছেন। কবির চেতনারূপ পাখি বসে আছে সবুজ তুলনা করেছেন। কবির চেতনারূপ পাখি হয়ে বসে আছে সবুজ অরণ্যের এক চন্দনের ডালে। ‘সবুজ’ হচ্ছে প্রাণস্ফূর্ততার আর ‘চন্দন’ স্নিগ্ধ সুগন্ধের প্রতীক, যা কবির খুব পছন্দ।
“মাথার ওপরে নিচে বনচারী বাতাসের তালে
দোলে বন্য পানলতা, সুগন্ধ পরাগে মাখামাখি
হয়ে আছে ঠোঁট তার।”
অরণ্যে বয়ে যাওয়া বাতাসে দোল খায় বন্য পানলতা। চন্দনের ডালে বসে থাকা কবির চেতনা পাখিরও অরণ্যের রহস্যময় সৌন্দর্যের মধ্যে ফুলের সুগন্ধি পরাগে মাখামাখি হয় ঠোঁট। কবির অস্তিত্বের কাব্যভাষাও সৌন্দর্য আর সুগন্ধে মোহময় হয়ে ওঠে।
“আর দুটি চোখের কোটরে
কাটা সুপারির রং,পা সবুজ, নখ তীব্র লাল
যেন তার তন্ত্রে মন্ত্রে ভরে আছে চন্দনের ডাল”
যতদূর চোখ যায় কবি শুধু বাংলার অফুরন্ত রঙের মেলা দেখতে পান। কাটা সুপারির রং, পা সবুজ, নখ লাল এ যেন মাটি আর আকাশে মেলে ধরা কবির নিসর্গ উপলদ্ধির রূপময় প্রকাশ। সমন্বিত সৌন্দর্যের রহস্যে ভরে উঠেছে যেন তার সৃষ্টি।
“তাকাতে পারি না আমি রূপে তার যেন এত ভয়
যখনি উজ্জ্বল হয় আমার এ চেতনার মণি,
মনে হয় কেটে যাবে, ছিঁড়ে যাবে সমস্ত বাঁধুনি
সংসার ধর্ম সমাজ তুচ্ছ হয়ে যাবে লোকালয়।”
চন্দনের রং কাটা সুপারির মতো, ডাল সবুজ, পাপড়ি লাল, যেন এক যৌবনবতী চঞ্চল কিশোরী। তার রূপের বিভাসে কবির ভয় হয়। তবু চেতনার আকর্ষণ তীব্র হলে মনে হয় সংসার ধর্ম-সমাজের সমস্ত বন্ধন ছিঁড়ে তার রূপের তীব্রতায় একাকার হয়ে যেতে ইচ্ছে করে তাঁর। চিত্রকল্প, উপমা, অলংকার, শব্দের বাঁধুনিতে অনুপম কাব্যের ছটায় কবির দৃষ্টিও অলংকৃত হয়ে ওঠে।
“লোক থেকে লোকান্তরে আমি যেন স্তব্ধ হয়ে শুনি
আহত কবির গান। কবিতার আসন্ন বিজয়।”
কবি জানেন, তাঁর সৃষ্টির পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। তাতে নানা সমস্যা আছে, বাধাবিঘœ আর জীবনসংগ্রামের বিস্ময় জড়িয়ে থাকে। কিন্তু সবকিছু তুচ্ছ করে কবির কাছে সত্য হয়ে ওঠে তাঁর চেতনার রং-রূপ-রেখা-শব্দাবলির স্বপ্নসৌধ। উত্তীর্ণ হয় কবিতার সার্বভৌমত্ব, জয় হয় কবিতার। এই বিজয়ানন্দে সৃষ্টির প্রেরণায় কবি উদ্বুদ্ধ হন।
গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর (জ্ঞানমূলক):
১। ‘লোক লোকান্তর’ কবিতাটি নেয়া হয়েছে – ‘লোক লোকান্তর’ কাব্যগ্রন্থ থেকে। কবিতাটি এই কাব্যগ্রন্থের নামকবিতা।
২। ‘লোক লোকান্তর’ কবিতাটি কবির-আত্মপরিচয়মূলক কবিতা।
৩। কবির তার কাব্যচেতনাকে উপস্থাপন করেছেন – সাদা এক সত্যিকারের পাখির প্রতিমায়।
৪। কবির চেতনা পাখি বসে আছে – সবুজ অরণ্যে এক চন্দনের ডালে।
৫। চন্দনের ফুল – ঝাল মিষ্টি লবঙ্গ।
৬। কবির কাব্যসত্তার মধুরতার সঙ্গে নিহিত আছে – চন্দনের সম্পর্ক।
৭। চন্দনের ডালে বসে থাকা কবির চেতনা পাখির ওপরে নিচে বনচারী বাতাসের সঙ্গে দোল খায় – পানলতা।
৮। কবির চেতনা পাখির ঠোঁট মাখামাখি হয়ে আছে – সুগন্ধ পরাগে।
৯। কবির চেতনা পাখির চোখের রঙ – কাটা সুপারির রঙের মতো।
১০। কবির চেতনা পাখির পায়ের রঙ – সবুজ।
১১। কবির চেতনা পাখির নখের রঙ – তীব্র লাল।
১২। কবির চেতনা পাখির বিভিন্ন প্রত্যঙ্গের রঙের বর্ণনার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে- বিসর্গ উপলদ্ধির এক অনিন্দ্যপ্রকাশ।
১৩। সৃষ্টির প্রেরণায় কবি চিরকাল – উদ্বুদ্ধ হন।
১৪। সৃষ্টির প্রেরণায় উজ্জ্বল হয়ে কবির- চেতনায় মণি।
১৫। কবি চেতনার জগত গড়ে তোলেন – শব্দ দিয়ে।
১৬। বিচিত্র টানাপড়েন ও জীবন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে কবিকে উত্তীর্ণ হতে হয়- কবিতার সার্বভৌমত্বে।
১৭। কবি তার কাব্য চেতনাকে মূর্ত করে তুলতে চান- চিত্রকল্পের মালা গেঁথে গেঁথে।
১৮। কবিকে কাতর করে, আহত করে – সুগভীর বিচ্ছিন্নতাবোধের যন্ত্রণা।
১৯। কবি আগ্রহী – সৃষ্টির আনন্দকে উপভোগ করতে।
২০। কবির বিচ্ছিন্নতাবোধের বেদনাকে প্রশমিত করে – ‘তার সৃষ্টির বিজয় অবশ্যম্ভাবী’- এই প্রত্যয়।
২১। ‘লোক লোকান্তর’ কবিতাটির—
- ছন্দ – অক্ষরবৃত্ত
- চরণসংখ্যা – ১৪টি
২২। ‘লোক লোকান্তর’ কবিতায় রঙের উলেখ আছে – ৩টি (সাদা, লাল এবং সবুজ)।
অনুধাবনমূলক প্রশ্নোত্তর :
১। কবি তাঁর চেতনাকে সাদা পাখি কল্পনা করেছেন কেন?
উত্তর : স্নিগ্ধ প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে দেখার জন্য কবি তাঁর চেতনাকে সাদা পাখি হিসেবে কল্পনা করেছেন। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। প্রকৃতি তার রূপ রস-গন্ধ দিয়ে চিরকালই মানুষকে আকর্ষণ করে। আর মানুষ সেই আকর্ষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে ছুটে যায় প্রকৃতির মাঝে। এ ক্ষেত্রে কবিও ব্যতিক্রম নন। মূলত স্নিগ্ধ প্রকৃতির প্রতি কবির অকৃত্রিম ভালোবাসার কারণে তাঁর চেতনাকে সাদা পাখি হিসেবে কল্পনা করেছেন।
২। “সংসার সমাজ ধর্ম তুচ্ছ হয়ে যাবে লোকালয়।”- ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : প্রশ্নোক্ত চরণে কবির চেতনাজগতের পরিচয় পাওয়া যায়। ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতাটি আত্মপরিচয়মূলক কবিতা। সৃষ্টির প্রেরণায় কবি চিরকালই উদ্বুদ্ধ হন, উজ্জ্বল হয় তাঁর চেতনার মণি। পৃথিবীর কোন বিধিবিধান, কোন নিয়মকানুন, কোন ধর্ম, কোন সমাজ-সংস্কারের অধীন তিনি থাকতে চান না। তখন সবকিছু তাঁর কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। কবির কাছে একমাত্র সত্য হয়ে ওঠে চেতনাজগৎ, শব্দসৌধ, চেতনার রং-রূপ-রেখা। তিনি শব্দ দিয়ে গড়ে তুলতে চান চেতনার এক নতুন জগত। এ কারণেই তাঁর কাছে এই জাগতিক সমাজ, সংসার, ধর্ম, লোকালয় তুচ্ছ হয়ে যায়।
৩। “আমার চেতনা যেন একটি শাদা সত্যিকার পাখি”- চরণটির মধ্য দিয়ে কী প্রকাশ পেয়েছে, তা ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : “আমার চেতনা যেন একটি শাদা সত্যিকার পাখি’ বলতে কবির কাব্যচেতনাকে বোঝানো হয়েছে। কবি নতুন সৃষ্টির প্রেরণায় সর্বদা ক্রিয়াশীল। তিনি তাঁর চেতনার মণিকে তাই উজ্জ্বল করে রাখেন। প্রশ্নোক্ত চরণে কবি তাঁর কাব্যবোধ ও কাব্যচেতনাকে সাদা এক সত্যিকারের পাখির চিত্রকল্পে উপস্থাপন করেছেন। কবির এই চেতনাপাখি বসে আছে সবুজ অরণ্যের কোন এক চন্দনের ডালে। কবিসত্তার মধুরতার সঙ্গে চন্দনের সম্পর্ক নিহিত। উক্ত চরণে এই ভাবই প্রকাশ করা হয়েছে।
৪। ‘আর দুটি চোখের কোটরে কাটা সুপারির রং, পা সবুজ, নখ তীব্র লাল’- কথাটি দিয়ে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তর : ‘আর দুটি চোখের কোটরে কাটা সুপারির রং, পা সবুজ, নখ তীব্র লাল’- কথাটি দিয়ে কবি তাঁর চোখে নিসর্গ উপলদ্ধির রূপময় প্রকাশকে বুঝিয়েছেন। বাংলা জুড়ে যতদূর চোখ যায়, কেবল চোখে পড়ে বাংলার অফুরন্ত রং। কবির কল্পনায় বাংলা যখন অবয়ব লাভ করে তখন তিনি দেখেন তার পা সবুজ, নখ তীব্র লাল, চোখের কোটরে কাটা সুপারির রং। এ যেন মাটি আর আকাশে মেলে ধরা কবির নিসর্গ উপলদ্ধির অনিন্দ্য প্রকাশ। যেন কোন অদৃশ্য শিল্পীর তুলির আঁচড়ে আঁকা সুন্দর ছবি যার নাম বাংলাদেশ।
৫। ‘সুগন্ধি পরাগে মাখামাখি’ বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তর : ‘সুগন্ধি পরাগে মাখামাখি’ বলতে কবি বন্য সৌন্দর্য তাঁর হৃদয়ে প্রশান্তি সৃষ্টি করেছেন তা বুঝিয়েছেন। প্রকৃতির প্রতি অকৃত্রিম মমত্ববোধের কারণে কবি তাঁর চেতনাকে পাখি হিসেবে কল্পনা করে বনের মধ্যে প্রবেশ করেন। কবি তখন বনের মধ্যে নানা রকম বন্য সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করেন। যার মধ্যে অন্যতম হলো বনমধ্যে নানা রকম সুগন্ধির ছড়াছড়ি, যা কবি হৃদয়ে প্রশান্তি বয়ে আনে।
৬। বন্য প্রকৃতিতে কবি তাঁর দৈহিক অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন কীভাবে? ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : বন্য প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে কবি তাঁর দৈহিক অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন। বন্য প্রকৃতির মাঝে কবির দেহও যেন সেজে উঠেছে নবরূপে। তাই তাঁর চোখ দুটি কাটা সুপারির রং ধারণ করেছিল, পা ধারণ করেছিল সবুজ রং আর নখ তীব্র লাল রং। এভাবে কবি বন্য প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে তাঁর দৈহিক অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন।
৭। সাদা পাখির অবয়বে কবি কোন দিকটিকে উপস্থাপন করেছেন? ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতায় সাদা পাখির অবয়বে কবি তাঁর কাব্যচেতনাকে তুলে ধরেছেন। ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতায় কাব্যসত্তার মাধুর্য ও প্রবন্তাকে বোঝাতে কবি তাঁর কাব্যচেতনাকে এক সত্যিকারের সাদা পাখির প্রতীকে উপস্থাপন করেছেন। পাখিতুল্য এই কাব্যচেতনা ও কবিসত্তা সর্বদা শুভ্র সুন্দরের আধারে বিরাজমান। প্রাণের মধ্যে, প্রকৃতির মধ্যে, সৃষ্টির মধ্যে তার বসবাস। সেই সৃষ্টির প্রকৃত মাধুর্যকে প্রকাশ করতেই কবি তাঁর চেতনাকে সাদা পাখির অবয়বে কল্পনা করেছেন।
৮। কবির চেতনার মণি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে কেন?
উত্তর : সৃষ্টির প্রেরণায় উজ্জীবিত হন বলে কবির চেতনার মণি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কবি সৃজনশীল মানুষ। তাই তাঁর কাছে চেতনার জগৎ সত্য হয়ে ধরাপ দেয়। সেখানে তিনি শব্দ দিয়ে গড়ে তোলেন সৌধ, যা বাস্তব জীবন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে উত্তীর্ণ হয় কবিতার সার্বভৌমত্বে। আর নবসৃষ্টির এ প্রেরণা থেকেই কবির চেতনার মণি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
৯। ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতাকে আত্মজৈবনিক কবিতা বলার কারণ ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার কবি নিজের চেতনার কথা প্রকাশ করেছেন বলে এটিকে আত্মজৈবনিক কবিতা বলা হয়েছে। ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতায় কবি আল মাহমুদ তাঁর আত্মচেতনার কথা প্রকাশ করেছেন। তিনি তাঁর কবিসত্তার কথা ফুটিয়ে তুলেছেন পাখির অবয়বে। যে পাখি স্বাধীন, সুন্দর ও রহস্যময়তার স্বপ্নসৌধে আসীন। কবির কাব্যচেতনা সম্পর্কিত আত্মপোলদ্ধিকে তুলে ধরায় এই কবিতাকে ‘আত্মজৈবনিক কবিতা’ বলা হয়েছে।
১০। ‘তাকাতে পারি না আমি’ – কবি কোথায় তাকাতে পারেন না? – ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : চেতনার পাখির রূপে কবি তাকাতে পারেন না। কবি বাংলার অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতিকে ভালোবাসেন। এই প্রকৃতিই তাঁর কাব্য সৃষ্টির একমাত্র অবলম্বন। প্রকৃতিই তাকে দিয়েছে কাব্য সৃষ্টির অলৌকিক ক্ষমতা। মূলত প্রকৃতির সৌন্দর্যই তন্ত্রে মন্ত্রে, রহস্যময়তায় ভরে দিয়েছে কবির সৃষ্টি। আর সে রূপের তীব্রতায় কবি সেখানে তাকাতে পারেন না।
উদ্দীপকের বিষয় :
- অমরত্ব লাভের আকাঙ্খা।
- সৃষ্টির মাঝে অমরত্ব লাভ।
- কবির চেতনাজগৎ।
- প্রকৃতির সৌন্দর্যের মাঝে হারানোর হাতছানি।
- শৈশব স্মৃতিতে গ্রামবাংলার সবুজ প্রকৃতিক ও হৃদয়ানুভূতি।
- জন্মভূমির প্রতি গভীর ভালোবাসা।
- অমততা লাভের আকাঙ্খা।
- একজন জীবনসংগ্রামীর চেতনাজগৎ।
- বাংলা প্রকৃতির চিরন্তন রূপ।
- স্বদেশপ্রেম।
- কবির চেতনাজগৎ।
- ব্যক্তির চেতনায় স্বদেশ।
- দেশের জন্য সবকিছু তুচ্ছ করা।
সারকথা : কবির নানা বিষয় অনুষঙ্গের সমন্বয়ে চিত্রকল্পের মালা গেঁথে তাঁদের কাব্যের অবয়ব গড়ে তোলেন। উদ্দীপক ও ‘লোক-লোকান্তর’ কবিতার কবিদ্বয়ও তাই করেছেন। তাঁদের কাব্যভাবনা ও জীবনচেতনার রূপ অভিন্নভাবে ধরা পড়েছে।
প্রথম লাইন : আমার চেতনা যেন একটি সাদা সত্যিকার পাখি।
শেষ লাইন : আহত কবির গান। কবিতার আসন্ন বিজয়।
নং | বিষয় | লেখক |
১ | আমার পথ | কাজী নজরুল ইসলাম |
২ | বিড়াল | বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় |
৩ | চাষার দুক্ষু | বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত |
৪ | সাম্যবাদী | কাজী নজরুল ইসলাম |
৫ | ঐকতান | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
৬ | বিভীষণের প্রতি মেঘনাদ | মাইকেল মধূসুদন দত্ত |
৭ | বায়ান্নর দিনগুলো | শেখ মুজিবুর রহমান |
৮ | অপরিচিতা | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর |
৯ | মাসি-পিসি | মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় |
১০ | জীবন ও বৃক্ষ | মোতাহের হোসেন চৌধুরী |
১১ | আমি কিংবদন্তির কথা বলছি | আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ |
১২ | নেকলেস | গী দ্য মোপাসাঁ/ পূর্ণেন্দু দস্তিদার |
১৩ | রেইনকোট | আখতারুজ্জামান ইলিয়াস |
১৪ | নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় | সৈয়দ শামসুল হক |
১৫ | তাহারেই পড়ে মনে | সুফিয়া কামাল |
১৬ | ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ | শামসুর রাহমান |
১৭ | রক্তে আমার অনাদি অস্থি | দিলওয়ার খান |
১৮ | সেই অস্ত্র | আহসান হাবিব |
১৯ | মহাজাগতিক কিউরেটর | মুহম্মদ জাফর ইকবাল |
২০ | আঠারো বছর বয়স | সুকান্ত ভট্টাচার্য |